বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ১০:০২ অপরাহ্ন
খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী::
গুনাহ বা পাপাচারগুলোর মধ্যে ‘শিরক’ হচ্ছে সবচেয়ে বড় পাপ। আল্লাহর সাথে অংশিদারিত্ব স্থাপনের নাম শিরক। তার বিপরীত শব্দ ‘তাওহীদ’ বা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপন করা। ইসলাম গ্রহণ তথা মুসলমান হওয়ার জন্য প্রথম শর্ত হচ্ছে তাওহীদ, আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস স্থাপন করা। শিরককে বলা হয়েছে মহাপাপ, মোমেন মুসলমানের বিপরীত মোশরেক-কাফের, যাদের ঠিকানা জাহান্নাম।
শিরকের পর মহাপাপ হলো অন্যায়ভাবে কোনো মানুষের প্রাণ হরণ করা, অর্থাৎ মানুষ হত্যা করা। মুসলিম প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত সহি হাদীস অনুযায়ী, আল্লাহতাআলা কিয়ামতের দিন লোকদের মধ্যে হত্যার বিষয়গুলো সম্পর্কে ফয়সালা ঘোষণা করবেন এবং আমলগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম নামাজকে দেখবেন। রসূলুল্লাহ (সা.) আরো বলেছেন: ‘আল্লাহর নিকট দুনিয়ার সমস্ত অস্তিত্বধারী বস্তু সমেত ধ্বংস হয়ে যাওয়া এতই কঠিন নয়, যত কঠিন একজন মুসলমানের নিহত হওয়া।’ (মুসনাদে ইবনে আহমদ)।
স্পেনীয় হাফেজে হাদীস তাকির মোসনাদ ও বাজ্জাজে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘যদি ধরেও নেয়া হয় যে, আসমান ও জমিনের সকল অধিবাসী একজন মুসলমানকে হত্যর ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করে তবে আল্লাহ তাআলা অবশ্যই তাদের সকলকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।’
অপর এক স্থানে হুজুর (সা.) বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি মুসলমানকে হত্যা করার ব্যাপারে অর্ধ শব্দ দ্বারাও সাহায্য করে, কিয়ামতের দিন সে এমনভাবে উপস্থিত হবে যে তার কপালে লেখা থাকবে, ‘এই ব্যক্তি আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ।’ অন্যায়ভাবে কোনো মুসলমানকে হত্যা করার বিরুদ্ধে কোরআনে যেমন বহু সতর্কবাণী রয়েছে, তেমনি হুজুর (সা.)-এর অনেক হাদীসও রয়েছে এবং ফিকাহ এর গ্রন্থগুলোতে হত্যার যাবতীয় আহকাম-বিধি বিধান স্ববিস্তারে বর্ণিত হয়েছে।
মদীনায় রসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায় হত্যার যেসব ঘটনা ঘটেছে এবং তার দরবারে ফয়সালার জন্য পেশ করা হয়েছে সেগুলোর সংখ্যা কম নয়। হত্যার ঘটনাবলি নানা শ্রেণির ও রকমারি। তিনি সেগুলোর ফয়সালা কিভাবে দিয়েছেন কয়েকটি দৃষ্টান্ত হতে তা স্পষ্ট। তার আগে বিশে^ হত্যার প্রথম ঘটনাটি স্মরণ রাখা দরকার।
বাবা আদমের দ্ইু পুত্র কাবিল ও হাবিলের কোরবানিকে কেন্দ্র করে দুনিয়ায় রক্তপাতের যে প্রথম ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল, কোরআনে সূরা মায়েদায় তার বিবরণ রয়েছে। বড় ভাই কাবিল ছোট ভাই হাবিলকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে প্রত্যেক নরহত্যার পাপের সে এক ভাগের অধিকারী হয়েছে। পরবর্তীকালে যুগে যুগে হত্যাকান্ডের নতুন নতুন ধরণ-করণ ও অভিনব কলা-কৌশলের উদ্ভব হয়েছে।
জেল-কারাগার, মৃত্যুদন্ড, ইত্যাদির প্রবর্তন হয়েছে। নানাভাবে, নানা অভিনব প্রক্রিয়ায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ফেতনা-ফাসাদ এবং খুনা-খুনির, রক্তারক্তির ঘটনাবলি প্রায় সর্বত্রই পরিলক্ষিত হয়, যা শয়তানের অট্টহাসিরও খোরাক যোগায়। চোখের সামনে, জানা-অজানায়, কারণে-অকারণে নিরীহ মানুষ গুম হয়ে যায়, খুন হয়ে যায়, অপহৃত হয়ে যায়। এসব সঙ্গতকারণেই চরম উদ্বেগ ও আতঙ্কের বিষয়।
ইসলামের প্রাথমিক যুগের দিকে তাকালে দেখা যায়, তখনো জাহেলি-বর্বর যুগের হত্যাকাস্ড প্রচলিত ছিল এবং অন্যায় হত্যার বিচার বা শাস্তি ছিল প্রাণের বদলে প্রাণ। অর্থাৎ মৃত্যুদন্ড অথবা শোণিতপণ, যার পরিমাণ ছিল নিহত ব্যক্তির ওয়ারেশগণ হলফের মাধ্যমে একশতটি উট পেতো।
খোদ রসূলুল্লাহ (সা.)-এর সময়ে এরূপ একটি হত্যাকান্ড ঘটেছিল, হত্যাকারী সম্পর্কে কেউ কিছু জানতো না, প্রত্যক্ষদর্শী বা কোনো সাক্ষীও ছিল না। এরূপ হত্যাকান্ডকে বলা হয়েছে ‘আল-কাসামাহ’। এর শাব্দিক অর্থ কসম করা, হলফ বা শপথ করা। শরীয়তের পরিভাষায় কাসামাহ বলা হয় সেই কসম বা হলফকে, যা এমন নিহত ব্যক্তি সম্পর্কে করা হয়, যাকে কোনো স্থানে ফেলে রাখা হয়েছে, কিন্তু হত্যাকারী অজ্ঞাত-অজানা।
এ অবস্থায় স্থানীয় মহল্লার সকল লোককে হলফ করে বলতে হবে যে, ‘আমরা নিহত ব্যক্তিকে হত্যা করিনি এবং তাকে কে হত্যা করেছে, তাও আমরা জানি না।’ অতঃপর নিহতের শোণিতপণ (জরিমানা) হত্যার বদলে হত্যা নয়, অর্থদন্ড ওয়াজিব হবে। সে যুগে শোণিতপণ বা অর্থদন্ডের পরিমাণ ছিল একশত উট বা নগদ নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ। হত্যাকান্ডের এ জরিমানা রসূলুল্লাহ (সা.) ও চালু রাখেন। অজ্ঞাত হত্যাকান্ডের এ ঘটনায় শোণিতপণ হিসেবে খোদ রসূলুল্লাহ (সা.) নিজেই একশ উট প্রদান করেছিলেন।